মৌ-পতঙ্গের ডানায় টিকে আছে আমাদের খাদ্য ও সংস্কৃতি

বাংলা গান, কবিতা ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান ভ্রমর বা মৌ-পতঙ্গ শুধু ভালোবাসার প্রতীক নয়, বরং প্রকৃতি ও মানুষের জীবনচক্রের নিঃশব্দ চালিকা শক্তি। রাধারমণ দত্তের মতো বাউল সাধকের গানে ভ্রমরের উপস্থিতি আমাদের সংস্কৃতির গভীর সংযোগের কথা বলে। কিন্তু আজ এই মৌ-পতঙ্গের বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে শুধু ঐতিহ্য নয়, মানব সভ্যতাও।

২০ মে পালিত হয় বিশ্ব মৌ-পতঙ্গ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল “Bee inspired by nature to nourish us all”। প্রকৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত মৌমাছিরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় বিশাল অবদান রাখে। তবে দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে এখনো এই দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি।

মৌ-পতঙ্গ বলতে শুধু মৌমাছিই নয় প্রজাপতি, ভোমরা, পাখি, বাদুড়, এমনকি কিছু মাছি ও পিঁপড়াও এর অন্তর্ভুক্ত। এরা পরাগায়নের মাধ্যমে গাছের ফল ও বীজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ খাদ্যশস্য এই পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল।

কিন্তু অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় ও নগরায়নের ফলে দিন দিন এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি পরাগবাহী অমেরুদণ্ডী প্রাণী, বিশেষ করে মৌমাছি ও প্রজাপতি, বিলুপ্তির ঝুঁকিতে।

আইনস্টাইনের কথাও স্মরণীয় “If the bee disappeared off the surface of the globe, then man would have only four years of life left.” এটি নিছক আতঙ্ক নয়, বরং বাস্তব বিপদের বার্তা। মৌমাছির সংকট মানেই মানুষের খাদ্য সংকট, পরিবেশ সংকট।

অন্যান্য দেশগুলো যেমন: ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, আমেরিকা ও নেপাল মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় নীতিমালা গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশ সেখানে অনেকটাই পিছিয়ে। আমাদের পরিবেশ আইন, জীববৈচিত্র্য আইন কিংবা কীটনাশক আইনেও পরাগবাহীদের সুরক্ষার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই।

গ্রামবাংলার কৃষিব্যবস্থায় মৌ-পতঙ্গের ঐতিহ্যগত ভূমিকা থাকলেও, আজ তা উপেক্ষিত। মনোকালচার, রাসায়নিক নির্ভরতা এবং গাছপালা নিধনের ফলে মৌ-পতঙ্গের আবাস ধ্বংস হচ্ছে। অথচ মৌ-পতঙ্গের অবদান ছাড়া কৃষি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

এখনই সময়

• মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় জাতীয় নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন করার।
• ক্ষতিকর কীটনাশক নিষিদ্ধ করা এবং পরাগবান্ধব কৃষি চালুর উদ্যোগ নেওয়ার।
• সচেতনতা বাড়ানো, যেমনটি বাঘ রক্ষায় করা হয়, তেমনটাই মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় জরুরি।

বাংলাদেশের খাদ্য ও কৃষিনিরাপত্তা টিকে আছে এই মৌ-পতঙ্গের ডানায়। তাই এই ক্ষুদ্র প্রজাতিগুলোর প্রতি অবহেলা মানেই আমাদের অস্তিত্বের প্রতি অবহেলা।