দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশ আসে লক্ষ্মীপুর থেকে

বাংলাদেশে সয়াবিন চাষের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে লক্ষ্মীপুর জেলা। কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশই আসে এই জেলা থেকে। চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জমিতে একসময়ের অনাবাদি জমিগুলো এখন সয়াবিন চাষের আওতায় এসেছে, যা কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন উপজেলায় এখন সবুজের সমারোহ। রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চর বংশী ইউনিয়নের চর কাছিয়া গ্রামে মাঠের পর মাঠ জুড়ে দেখা মিলছে সয়াবিন ক্ষেতের। ইউনিয়নটির প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক এবার সয়াবিন আবাদ করেছেন। শুধু এই ইউনিয়ন নয়, জেলার রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাতেই ব্যাপকভাবে সয়াবিন চাষ হচ্ছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ হাজার হেক্টর, তবে তা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ৪৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে।
কৃষি কর্মকর্তারা আশা করছেন, এবার লক্ষ্মীপুরে অন্তত ৮৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদিত হবে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩২০-৩৫০ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন ভোজ্যতেল ও পোলট্রি খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এখান থেকে সয়াবিন সংগ্রহ করে।
রায়পুর উপজেলার চর কাছিয়ার কৃষক ফারুক গাজী জানান, দেড় একর জমিতে চাষ করতে তার মোট খরচ হবে ২৫ হাজার টাকা। স্বাভাবিক উৎপাদন হলে তিনি ৭০ মণ সয়াবিন পাবেন, যা বাজারদরে বিক্রি করলে আয় হবে প্রায় ১ লাখ টাকা।
কৃষকদের মতে, সয়াবিন চাষের খরচ কম, রোগবালাই কম হয়, ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না, এবং ধানের তুলনায় বেশি লাভজনক। ফলে দিন দিন কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে।
লক্ষ্মীপুরের হায়দরগঞ্জ বাজারে এখন জমজমাট সয়াবিন ব্যবসা চলছে। এখানে ৪৫-৫০টি আড়তে পাইকারিভাবে সয়াবিন বিক্রি হয়। এছাড়া খাসেরহাট ও মোল্লারহাট বাজারেও ২০টির বেশি আড়তে সয়াবিন কেনাবেচা হয়। এপ্রিল ও মে মাসে এসব বাজারে সয়াবিনের বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি হয়।
ব্যবসায়ী সাইজুদ্দিন মোল্লার মতে, দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৭০ শতাংশই এই বাজারে বেচাকেনা হয়। ফলে লক্ষ্মীপুরের অর্থনীতিতে সয়াবিন চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ জানান, এখানকার মাটি সয়াবিন চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ কারণে প্রতিবছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে লক্ষ্মীপুর ‘সয়াল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবারও লক্ষ্মীপুরে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছেন, যাতে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলন পান।”
সয়াবিন শুধু তেল উৎপাদনের প্রধান উপকরণ নয়, এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। শুকনো সয়াবিন ডাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, পাশাপাশি শিশুখাদ্য, সয়া দুধ, দই, পনির, বিস্কুট, কেকসহ বিভিন্ন খাদ্য তৈরি হয়। এছাড়া পোলট্রি ও মাছের খাদ্য, রং, সাবান, প্লাস্টিক, ও মুদ্রণের কালি তৈরিতেও সয়াবিনের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম ও সরকারের কৃষি সহায়তার ফলে জেলাটি দেশের সয়াবিন উৎপাদনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।